আলোচনা সহজ করার জন্য ৫ টি পয়েন্টের উপর আলোচনা করা হবে,
- তাড়াতাড়ি ইফতার করারর তারগীব প্রদান বা উৎসাহ ও তাড়াতাড়ি ইফতার করতে বলার কারণ কি?
- তাড়াতাড়ি ইফতার না করলে কি কোন গুনাহ আছে?
- বর্তমান ক্যালেন্ডার বা ফাউন্ডেশন কর্তৃক সময় নির্ধারন করে যে কার্ড দেওয়া হয় সে ভিত্তিতে ইফতার করলে কি কোন ক্ষতি আছে?
- ৫ মিনিট কি খুব দেরি হয়ে যায় বলে কি বলা যাবে?
- পূর্ণ সতর্কতার পরেও তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে যদি সময়ের একটু আগে ইফতার করা হয়ে যায় তবে কি কোন সমস্যা আছে?
তাড়াতাড়ি ইফতার করারর তারগিব বা উৎসাহ প্রদান ও তাড়াতাড়ি ইফতার করতে বলার কারণ:
হাদিসে এসেছে:
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : لا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْر
অর্থ: সাহাল বিন সা’দ থেকে বর্নিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিসালাম বলেছেন, মানুষ যতক্ষণ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততকক্ষণ তারা কল্যাণের মধ্যে থাকবে। (বুখারি-১৯৫৭, মুসলিম- ১০৯৮)
روى أبو هريرة رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : قال الله تعالى : إن أحب عبادي إليَّ أعجلهم إفطاراً
অর্থ: আবু হুরায়রা(রাদি) থেকে বর্নিত,তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিসালাম বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমার কাছে আমার অধিক প্রিয় বান্দা হল, যে তাড়াতাড়ি ইফতার করে।
(মুসনাদে আহমাদ-৮৩৪২, তিরমিযী-৩/৩৭৬ )
قال أبو الدرداء رضي الله عنه : ” ثلاث من أخلاق النبوة تعجيل الإفطار ، وتأخير السحور ، ووضع اليمين على الشمال في الصلاة “
অর্থ: আবু দারদা(রাদি) বলেছেন, তিনটি জিনিস নবীদের আখলাক। তাড়াতাড়ি ইফতার করা, দেরি করে সাহরী করা ও নামাজে বাম হাতের উপর ডান হাত রাখা।(মাযমাউয যাওায়েদ-২/১৫০)
قال النبي صلى الله عليه وسلم : لا يزال الدين ظاهراً ما عجل الناس الفطر لأن اليهود والنصارى يؤخرون
অর্থ: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিসালাম বলেছেন, দীন বিজয়ী হতে থাকবে মানুষ যতক্ষণ তাড়াতাড়ি ইফতার করতে থাকবে। কেননা, ইয়াহুদি- নাসারাগণ দেরি করে ইফতার করে।
(মুসনাদে আহমাদ-২৭২১৮, আবু দাউদ-২৩৫৩)
এসকল হাদিস থেকে বুঝে আসে যে, তাড়াতাড়ি ইফতার করা অনেক উত্তম একটি আমল। নবীদের সুন্নাহ এবং ইয়াহুদি-নাসারাদের খিলাফ কর্ম।
আর কল্যাণ বলতে অনেকে অনেক রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার মধ্যে একটা হল, মুসলিম যতক্ষণ পর্যন্ত সামান্য কাজেও ইয়াহুদি-নাসারাদের খেলাফ করতে থাকবে ততক্ষণ আল্লাহ তাদেরকে কল্যাণের উপর রাখবে। যেহেতু তাদের ফিতরাত এতে সঠিক থাকবে।
তাড়াতাড়ি ইফতার না করলে কি কোন গুনাহ আছে?
ইমাম নববী(রাহি) লিখেছেন,
قال القاضي أبو الطيب في المجرد: قال الشافعي في الأم إذا أخر الإفطار بعد تحقق غروب الشمس، فإن كان يرى الفضل في تأخيره كرهت ذلك، لمخالفة الأحاديث، وإن لم يرد الفضل في تأخيره فلا بأس،
অর্থ: কাযী আবু তয়য়িব ‘মুজাররিদে’ বলেছেন, শাফেয়ী(রাহি) ‘উম্ম’ কিতাবে বলেছেন, সূর্যাস্ত হওয়া জানার পরও সে দেরি করে ইফতার করে, কেননা, দেরি করে ইফতার করা সে উত্তম বা ভাল মনে করে, তবে তার এ কাজটি সুন্নাতের খেলাফ হবার কারনে মাকরুহ হবে। আর যদি সে দেরি করা উত্তম মনে না করে, তবে কোন কারনে দেরি হলে সমস্যা নেই।
তাযুল ইকলিলে” আছে,
“ابن حبيب: إنما يكره تأخير الفطر استناناً وتديناً، فأما لغير ذلك فلا، كذا قال لي أصحاب مالك”
অর্থ: ইবনে হাবীব, সুন্নাহ ও দীন মনে করে দেরিতে ইফতার করাকে মাকরুহ বলেছেন। তবে অন্য কোন কারনে দেরি হলে মাকরুহ মনে করতেন না। ইমাম মালেকের সাথীরা আমাকে এমনি বলেছেন।
সুতরাং ইফতার দেরিতে করা উত্তম বা ভাল মনে করলে মাকরুহ হবে। তবে অন্য কোন কারণে দেরি হয়ে গেলে মাকরুহ হবে না। যেমন কোথাও থেকে আসার কারনে ইফতার করার মত কিছু না পাওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি। সতর্কতা নাম দিয়ে বা সতর্কতার খাতিরে বেশ দেরি করে ইফতার করা-ও মাকরুহ।
বর্তমান ক্যালেন্ডার বা ফাউন্ডেশন কর্তৃক সময় নির্ধারন করে যে কার্ড দেওয়া হয় সে ভিত্তিতে ইফতার করলে কি কোন ক্ষতি আছে?
শায়েখ বিন বায(রাহি)কে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন,
ما في بأس، اللجنة مجتهدة وجيدة وعملها طيب، الأذان على التقويم، لا حرج.
অর্থ:এতে কোন সমস্যা নেই। (কেননা) বোর্ডের লোকের তো এই ব্যাপারে বিজ্ঞা ও অভিজ্ঞ হয়। এবং তাদের কাজ অনেক উত্তম(দক্ষতাপূর্ণ)। (সুতরাং তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে বানোন) ক্যালেন্ডারের সময় মত আযান দেওয়া (ও ইফতার করাতে ) কোন সমস্যা নেই।
বি:দ্র: শায়েখকে করা প্রশ্নটি যেহেতু ইফতার নিয়ে ছিল তাই ব্যারিকেডের মাঝে ইফতার শব্দটি যোগ করেছি।ক্যালেন্ডার যদি কোন যোগ্য ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের থেকে প্রকাশিত হয়। যাদের উপর আস্থা রাখা সম্ভব, তাহলে তাদের কথার ভিত্তিতে আমল করা উচিত। সন্দেহ করে দেরি করার দরকার নেই। কেননা, আমাদেরকে না-জানা বিষয়টি সেই ব্যাপারে জানা ব্যক্তি থেকে শুনে নিয়ে আমল করতে বলা হয়েছে। সন্দেহ করতে নেই।
মিনিট কি খুব দেরি হয়ে গিয়েছে বলে কি বলা যায়?
দেরির কোন নির্দিষ্ট সীমা শরিয়তের থেকে পক্ষ থেকে নির্ধারন করে দেওয়া হয়নি। এটা সমাজের উরফ বা রীতিনীতির উপর রেখে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সমাজে সাধারণত ৫ মিনিট খুব দেরি হয়েছে বলে মনে করা হয় না। ৫ মিনিট মানে অনেক দেরি হয়েছে মনে করে মারামারির কোন দরকার নেই। তবে এক্ষেত্রে-ও তাড়াতাড়ি করা উত্তম। হাদিসে এসেছে,
دَخَلْتُ أَنَا وَمَسْرُوقٌ عَلَى عَائِشَةَ فَقُلْنَا يَا أُمَّ الْمُؤْمِنِينَ : رَجُلانِ مِنْ أَصْحَابِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحَدُهُمَا يُعَجِّلُ الإِفْطَارَ وَيُعَجِّلُ الصَّلاةَ ، وَالآخَرُ يُؤَخِّرُ الإِفْطَارَ وَيُؤَخِّرُ الصَّلاةَ ..
قَالَتْ : أَيُّهُمَا الَّذِي يُعَجِّلُ الإِفْطَارَ وَيُعَجِّلُ الصَّلاةَ ؟
قَالَ قُلْنَا عَبْدُ اللَّهِ يَعْنِي ابْنَ مَسْعُودٍ
قَالَتْ كَذَلِكَ كَانَ يَصْنَعُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
অর্থ: আবী আতিয়াহ থেকে বর্নিত,সে বলেছেন, আমি ও মাসরুক আয়েশা(রাদি) এর কাছে আসলাম। অতপর তাকে বললাম, হে উম্মুল মু’মিনীন! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিসালামের সাথীদের মধ্যে দুই ব্যক্তির একজন ইফতার ও নামাজ তাড়াতাড়ি আদায় করে। আর অন্যজন ইফতার ও নামাজ দেরি করে আদায় করে।
তিনি বললেন, দুইজনের মধ্যে কে ইফতার ও নামাজ তাড়াতাড়ি আদায় করে?
তিনি বলেন, আমরা বললাম, আব্দুল্লাহ অর্থাৎ ইবনে মাসউদ।
তিনি বললেন,রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিসালাম এমনটি করতেন।
(মুসলিম- ১০৯৯)
পূর্ণ সতর্কতার পরেও তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে যদি সময়ে একটু আগে ইফতার করা হয়ে যায় তবে কি কোন সমস্যা আছে?
হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَتْ أَفْطَرْنَا عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ غَيْمٍ ثُمَّ طَلَعَتْ الشَّمْسُ ..
অর্থ: আসমা বিনতে আবু বকর (রাদি) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিসালামের যুগে একদিন মেঘাচ্ছন্ন দিনে ইফতার করলাম। অতপর সূর্য উদিত হলল(অর্থাৎ সূর্য ডুবে ছিল না। তারা ভুল করে সূর্য ডোবার কিছু পূর্বে ইফতার করে ফেলে।)
(বুখারি-৪/১৯৯)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া(রাহি)এই হাদিসের ব্যাখ্যা বলেন,
وهذا يدل على شيئين : أنه لا يستحب مع الغيم التأخير إلى أن يتيقن الغروب ، فإنهم لم يفعلوا ذلك ولم يأمرهم به النبي صلى الله عليه وسلم ، والصحابة مع نبيهم أعلم وأطوع لله ولرسوله ممن جاء بعدهم .
والثاني : لا يجب القضاء ، فإن النبي صلى الله عليه وسلم لو أمرهم بالقضاء لشاع ذلك ولنقل ذلك كما نقل فطرهم فلما لم ينقل ذلك دل على أنه لم يأمر به .
অর্থ:এই হাদিস দু’টি জিনিসের প্রতি ইংগিত করে,
প্রথম: আকাশে মেঘ থাকলে সূর্য ডোবার একিন না হওয়া পর্যন্ত ইফতার দেরিতে করা মোস্তাহব নয়। (বরং এমন অবস্থায়-ও স্বাভাবিক চেষ্টার পর ইফতারের ক্ষেত্রে দেরি না করা।)তারা এমন করেনি।(চেষ্টা করার পরও সন্দেহ করে বসে থাকেনি)আর না নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিসালাম তাদেরকে এমন করার আদেশ দিয়েছে। সাহাবাগন তো পরবর্তীদের থেকে অধিক জ্ঞানী ও অধিক আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত ছিল।
দ্বিতীয় : এ ভুলের কারনে তাদের উপর কাযা ওয়াজিব হয়নি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিসালাম তাদেরকে কাযার আদেশ দেননি। যদি দিতেন তবে বিষয়টি প্রসিদ্ধ ও বর্নিত হত ইফতারের বিষয়টির মত। এভাবে বর্নিত না হওয়া এ দিকে ইংগিত করে যে, কাজার আদেশ দেয়া হয়নি।
বি:দ্র: তবে ভুলবশত খাওয়ার সময় যদি জানাতে পারে এখন সময় হয়নি তবে সাথে সাথে খাবার খাওয়া বাদ দিবে। ভুলবশত খাওয়া মাফ ছিল কিন্তু ইচ্ছা করে খেলে মাফ হবে না। রোযা বাতিল হয়ে যাবে।
নোট: হিশাম বিন উরওয়া থেকে রোযা কাজা করার একটি বর্ননা পাওয়া যায়, যা সহীহ না। শাইখুল ইসলাম কেন সহীহ না? সেসে বর্ননা তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন। নিচের রেফারেন্স থেকে দেখে নিন।
(হাকিকতুস সিয়াম-৩৩-৩৪, মাযমাউল ফাতওয়া-২৫/২৩১, ফাতহুল বারী- ৪/১৯৯)
